বাবা
-সঞ্চিতা রায়
শহরের নামী চিকিৎসক সুমিষ্টা আজ খুব ব্যস্ত। তার বাবাকে আজ সে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। এমন বাবা পেয়ে সে গর্বিত। শ্রী রীতম চক্রবর্তী ভাবছেন,আজ তার জন্য খুব ভাল দিন। হয়তো তার মেয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবে সবার সাথে। শত হলেও জন্মদাতা বাবা তো! প্রতি বছর সুমিষ্টা তার জন্মদিনে একটা সুন্দর অনুষ্ঠান করে দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বই,খাতা,পেন ইত্যাদি দেয়। এছাড়া থাকে বস্ত্র বিতরণ ও বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজ। মাকে মঞ্চে তুলে সুমিষ্টা সব সময় জানায়,তার জীবনে তার মায়ের অবদানের কথা।
একক মা হিসাবে তাকে মানুষ করার গল্পটা অনেকেরই জানা হয়ে গেছে।
সৃষ্টি চক্রবর্তী মানে সুমিষ্টার মা সেদিন প্রথম জানতে পারলেন, তিনি মা হতে চলেছেন,আনন্দে তাঁর মন ভরে উঠলো। তাঁর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখবে একটা নতুন জীবন। শ্বশুরবাড়ির সকলে এবং তাঁর বর তাঁকে বলতে শুরু করলো‘ছেলের মুখ দেখব’। কিন্তু কেন? সৃষ্ঠির বক্তব্য মেয়েও তো হতে পারে,সে নিজেও মেয়েই চায়। ধমকের পর ধমক না না স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির কেউ মেয়ে চায় না। নির্দিষ্ট দিনে বাড়ির কাছে একটি নার্সিং হোমে জন্ম হ’ল একটা মিষ্টি কন্যা সন্তানের। মাতৃত্বের সুন্দর অনুভূতিতে ভরে উঠলো সৃষ্টির মন প্রাণ। রীতম কন্যা সন্তানের জন্মের কথা জানতে পেরে ,জানিয়ে দেয় মা এবং মেয়ে দুজনের কাউকেই সে আর বাড়িতে নেবে না। সৃষ্টির মা অনুরোধ করতে থাকেন জামাইকে। দৃঢ় কন্ঠে সৃষ্টি বলে না সে এই রকম বাবার কাছে তার সন্তানকে নিয়ে যেতে চায় না। সে তো বিয়ের আগে চাকরি করতো,তার একটা ছোট বুটিক ও ছিল। সব মিলিয়ে তার ভালই রোজগার ছিল। শুধুমাত্র বাবা মায়ের কথা রাখতে,পরিস্থিতির চাপে পড়ে সে চাকরি ছেড়ে বিয়ে করেছিল। মা বাবাকে জানায় সে আবার চাকরি খুঁজে নেবে। তার আগের কর্মক্ষেত্রই তাকে আবার ডেকে নেয়। সঙ্গে ব্যাবসাটাও আবার চালু করে। আগের কিছু সঞ্চয় ও এখনকার রোজগারে বড় করতে থাকে সুমিষ্টাকে।
জয়েন্টে চান্স পায় সুমিষ্টা। ডাক্তারি পাস করে। ক্রমে ডাক্তার হিসাবে খুব নাম করে। এই ঘটনা আজ অনেকেরই জানা। কিন্তু আরো একজন মানুষ যার কথা কোনোদিন জানানো হয়নি,সেই মানুষটির কথা আজ জানাতে চলেছে সুমিষ্টা।
এই মানুষটাকে সে ছোট থেকে ‘বাবামত’ বলে ডেকে এসেছে। এই মহান মানুষটির নাম শোভন রায়। সুমিষ্টার মা বাবার ডিভোর্সের পর যেই মানুষটা তার মায়ের পাশে বন্ধুর মত দাঁড়িয়েছিলেন। বাস্তবিক পক্ষে তিনি সৃষ্টিকে ভালবেসে ফেলেছিলেন। বিয়েও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় যেন সৃষ্টির একটা ভয় ছিল,যদি নতুন শ্বশুরবাড়িতে আবার অবহেলিত হয় তার মেয়ে। শোভন অনেক আশ্বাস দেওয়া সত্বেও রাজী হয় নি সৃষ্টি। শোভন কিন্তু সরে যায় নি সৃষ্টির পাশ থেকে। ছোট্ট সুমিষ্টা মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতো‘তুমি আমার কে হও’?উত্তর আসতো “আমি তোমার বাবার মত”। সৃষ্টিও একদিন বলেছিল“উনি তোমার বাবার মত”। সেই থেকে সুমিষ্টা শোভনকে বাবামত বলে ডাকতো। বাবার মত থেকে এই ডাকের উৎপত্তি।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই মানুষটা তার বাবার ভূমিকা পালন করেছে। আদরে আব্দারপূরণে ভরিয়ে রেখেছে সুমিষ্টাকে। রীতম আবার বিয়ে করেছিল। সেখানে তার পুত্র হয়। আজ সেই পুত্র বিদেশে। বাবা মায়ের খোঁজ ও নেয় না। খুব অসুস্থ হয়ে সুমিষ্টার তত্বাবধানে একবার নার্সিংহোমে ছিল সে। খুব চেষ্টা করেছিল সুমিষ্টার কাছে বাবা ডাক পাওয়ার। সুমিষ্টা জানিয়েছিল,সে তার কাছে আর পাঁচজন রোগীর মত একজন রোগী মাত্র। বাবা নয়। আজকে রীতম ভেবেছিল,আজ হয়তো তার স্বীকৃতি আসবে। কিন্তু না ,মঞ্চে নিয়ে এসে বাবা বলে সুমিষ্টা পরিচয় করালো শোভনকে। ‘জন্মদাতা হলেই বাবা হওয়া যায় না,আমার জীবনে এই মানুষটাই প্রকৃত বাবা’।
‘বাবা মত’ নয় আজ থেকে তোমাকে বাবা বলে ডাকবো। আর হ্যাঁ আপনাদের জানাই কিছুদিন আগে আমি বাবা মায়ের রেজিস্ট্রি করিয়ে দিয়েছি। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। এতদিন তাঁরা আমার জন্য অনেক ভালো কাজ করেছেন,আজ আমার পালা।
শোভন রায় ও সৃষ্টির চোখে আনন্দাশ্রু।